অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। আন্তর্জাতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। লিখছেন, গবেষণা করছেন বিশ্ব রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে। পেশাগত কারণে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায়।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। ওই হামলার ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটা ধাঁধার অবতারণা করেন। বলেন, হামলা কারা এবং কেন করেছে, তা নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি। আর জঙ্গি সংগঠন আইএসকে জড়িয়ে ওই হামলার যে দায় স্বীকার হচ্ছে, তা যথেষ্ট অনুমাননির্ভর।
দীর্ঘ আলোচনায় গুরুত্ব পায় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য প্রসঙ্গও। ভারতের চলতি নির্বাচন নিয়ে মতামত জানিয়ে তিনি বলেন, এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ওই দেশে হিন্দু জাতীয়তাবাদের চরম বিকাশ ঘটছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এখনই বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরব হওয়ার আহ্বান জানান এ বিশ্লেষক। চার পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।
ইমতিয়াজ আহমেদ : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো একটা শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী হলে বিশ্ব অঙ্গনে শত্রুতা বাড়ে। এ কারণে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির এ সময়ে কিছু কৌশল অবলম্বনের প্রয়োজন। প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ হলে কমিয়ে তা ৬ শতাংশ বলা উচিত। আমার সম্পদ বাড়িয়ে বললে তো সবার চোখে লাগবে।
একজন ব্যবসায়ীর কাছ থেকেই এমন শিক্ষা নেয়া যায়। কোনো ব্যবসায়ীকে যদি প্রশ্ন করা হয়, আপনার ব্যবসা কেমন যাচ্ছে। ভালো হলেও সে বলবে, ভালো যাচ্ছে না। ব্যবসার নীতিই এটা। এ সংস্কৃতি রাষ্ট্রকেও ধারণ করা উচিত। অথচ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই সবসময় বাড়িয়ে বলা হয়। এটা ঠিক নয়। দৃশ্যমান উন্নয়ন হলে মানুষের চোখে পড়বেই। ঢোল পিটিয়ে বলার কিছু নাই। মানুষের জীবনযাপন থেকেই রাষ্ট্র, সমাজের উন্নয়ন উপলব্ধি করা যায়। বরং রাষ্ট্র তা প্রকাশ করে বেড়ালে ঘরে-বাইরে শত্রু বাড়বে।
ইমতিয়াজ আহমেদ : আমরা উন্নয়নের কথা বলছি, অথচ হলি আর্টিজানের হামলা ঠেকাতে পারিনি। আমাদের কোথাও না কোথাও অবশ্যই ব্যর্থতা আছে। আমাদের গোয়েন্দারা কী করলেন? আসলে সক্ষমতা কোথায় অর্জিত হওয়া উচিত সেটা নিয়েই ভাবনার বিষয়। ৯/১১-এর বছর যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক খাতে বরাদ্দ ছিল ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ সেই সামরিক শক্তি টুইন টাওয়ার ধ্বংস ঠেকাতে পারেনি। গোয়েন্দারা ব্যর্থ হয়েছিল। গোয়েন্দারা ব্যর্থ হলে পারমাণবিক বোমা থেকেও কোনো লাভ নাই। গুলশান-বারিধারাজুড়ে পুলিশ চেকপোস্ট দেখতে পাবেন। এগুলো তো ভাবমূর্তি আরও নষ্ট করছে। কোনো লাভ নাই এসবের, যদি না গোয়েন্দারা তৎপর না হয়।
মনে রাখতে হবে, পোশাক রফতানি আর প্রবাসী শ্রমিকদের আয়ের ফলেই আমাদের আজকের উন্নয়ন এবং দুটা সেক্টরেই বিশ্বায়নের প্রভাব রয়েছে। ওই দুটা সেক্টরে যদি কোনোভাবে কেউ ইমেজ নষ্ট করে তাহলে আমাদের গোয়েন্দারা তা উদ্ধারের সক্ষমতা রাখবেন বলে মনে হয় না। এখন প্রতিযোগিতার সময়। আমরা ব্যর্থ হলে, অন্যরা সে জায়গা দখল করবে। এ কারণেই আমি মনে করি, আমাদের সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা গবেষণা দরকার। গোয়েন্দাদের জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া জরুরি।
ইমতিয়াজ আহমেদ : সেন্টমার্টিনে বিজিবি মোতায়েন ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। তাদের মানচিত্রে বারবার সেন্টমার্টিনকে দেখানো হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ তো আর বসে থাকবে না।
ইমতিয়াজ আহমেদ : মিয়ানমার জানে বাংলাদেশ যুদ্ধে জড়াবে না। এ কারণেই বিরক্ত করে অস্থিরতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। অস্থিরতা বাড়লে রোহিঙ্গা ইস্যু হয়ত আরও ১০ বছর চাপা দিয়ে রাখতে পারবে। রোহিঙ্গা ঠেকাতে বাংলাদেশও সামরিক অবস্থান নিতে পারত। কিন্তু তা করেনি। বাংলাদেশ সরকারের কাছে নির্বাচন গুরুত্ব পেয়েছিল ওই সময়। নির্বাচন শেষ। এখন অবস্থান পরিবর্তন করে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধান নিয়ে কথা বলা উচিত।
প্রধানমন্ত্রী ব্রুনাই সফর করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোর দিয়ে কথা বলেছেন। সামরিক কাঠামো থেকেও শারীরিক ভাষা পরিবর্তন করে এখন কথা বলা দরকার বলে মনে করি।
ইমতিয়াজ আহমেদ : ইউরোপের শরণার্থী আর বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে পার্থক্য আছে। এর আগেও রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছিল। ফেরতও গেছে।
এবারের বিষয়টা আলাদা। গুটি কয়েক দেশ বাদে সবাই মনে করছে, মিয়ানমার গণহত্যা করেছে এবং তার যথেষ্ট প্রমাণও আছে। মিয়ানমারের বিষয়টা আর দ্বিপক্ষীয় নাই। রোহিঙ্গারা ফিরে গেলেও ইস্যুটা চাপা পড়ার সুযোগ নাই। সত্তরের দশকে আন্তর্জাতিক আদালত ছিল না। আন্তর্জাতিক আদালত রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। আজ অথবা কাল মিয়ানমারের সামরিক কর্তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবেই। অং সান সুচিও পশ্চিমা দেশে যেতে পারছেন না। শুধু চীনেই বারবার যাচ্ছেন। এর কারণ হচ্ছে, মিয়ানমার অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ কী করতে পারত। মনে রাখতে হবে, গণহত্যার ব্যথা বাংলাদেশেরও আছে। ১৯৭১ সাল তো ভোলা যায় না। সামাজিক কারণেই সরকারের পক্ষে রোহিঙ্গাদের ঠেকানো সম্ভব হতো না। এখন প্রযুক্তির সময়। সবার হাতেই ক্যামেরা। নিরাপত্তারক্ষীরা রোহিঙ্গাদের ঠেকিয়ে দিচ্ছে, সাহায্য করছে না- এমন ছবি বিশ্বদরবারে প্রকাশ পেলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ভালো হতো না।
ইমতিয়াজ আহমেদ : আমি মনে করি, এ বছর রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিকীকরণ বাড়বে। গত দু’বছর ধরে বাংলাদেশ চেষ্টা করে যাচ্ছে। আমি বরাবরই বলে আসছি, এ সমস্যার দ্বিপক্ষীয় সমাধান হবে না।
বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারের কথায় আর আশ্বস্ত হতে পারছে না বলে বিশ্বাস করি। সময়ক্ষেপণ করে পরিস্থিতি মিয়ানমারের অনুকূলে রাখতে চাইছে। এ কারণে চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।
ইমতিয়াজ আহমেদ : আন্তর্জাতিকভাবে কথা বলার সময় এসেছে। গণহত্যার প্রমাণ মিলেছে। বাংলাদেশ সরকার সেভ জোনের কথা বলছে। প্রধানমন্ত্রী এবার জাতিসংঘের অধিবেশনে অংশ নিয়ে বিষয়টি আরও খোলাসা করবেন বলে বিশ্বাস। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোও এর সমাধান চাইছে।
সমস্যা হচ্ছে চীন ও ভারতকে নিয়ে। অং সান সুচিকে চীন বিশ্বাস করে না। তাকে পশ্চিমা প্রতিনিধি মনে করে। সুচিকে দিল্লি যত সমর্থন দিচ্ছে, চীন তত চিন্তিত হচ্ছে। কারণ দিল্লি ওয়াশিংটনের সঙ্গে।
ইমতিয়াজ আহমেদ : ভারত বা চীন কী করল, সেদিক চেয়ে বসে থাকলে চলবে না। নিজেদের তৎপরতা বাড়াতে হবে। ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী যে ভূমিকা রেখেছিলেন, বাংলাদেশকেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সেই ভূমিকা নিতে হবে। এ নিয়ে ঢাকাকে বারবার দিল্লি ও বেইজিং সফর করা দরকার।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্বকে চাপ দেয়ার সময় এসেছে। বাংলাদেশ যদি অস্থিরতা না দেখাতে পারে তাহলে অন্যরা এসে সমাধান করে দেবে না। বৈশ্বিক সমর্থন তো তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তথ্য নিয়ে কথা বলছে। বাংলাদেশের জন্য ভালো ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এটা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে আমরা যদি না পারি তাহলে সমস্যা জিইয়েই থাকবে।