ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশ সম্পর্কের হেরফের হবে না

পোস্ট এর সময় : ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ , ভিজিটর : ২

আলতাফ পারভেজ। গবেষণা করছেন দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাস নিয়ে। লিখছেন রাজনীতি ও ইতিহাসের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। ভারতের আসন্ন পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে মুখোমুখি হন । দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে নির্বাচনের সার্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন নির্মোহভাবে।

বলেন, বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে এখন রাজনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদের বিস্তার ঘটছে। এ কারণেই গণমানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলো নির্বাচনে চাপা পড়ছে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধের খবরে। যার পেছনে রয়েছে পুঁজির কর্তৃত্ব।

 ভারতের নির্বাচনে যদি বর্তমান শাসকনীতিই জারি থাকে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কোনো মঙ্গল বার্তা নেই

তার মতে, কংগ্রেস আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে বিশেষ ছাড় দিয়ে জোট গঠন করতে না পারলে নির্বাচনের ফলাফল বিজেপির পক্ষে যাবে। তবে আঞ্চলিক দলগুলোও এবারের নির্বাচনে ভালো করতে পারে বলে মত দেন। দীর্ঘ আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ও। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি।

আলতাফ পারভেজ : ভারত সামরিকভাবে আরও শক্তিশালী হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদও খুশি। কারণ পুঁজিবাদের স্বার্থই মুনাফা করা। ভারত সেই ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে।

 পুঁজিবাদের স্বার্থই মুনাফা করা। ভারত সেই ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে 

আলতাফ পারভেজ : আমি অন্তত খোলা চোখে দেখি, ভারতের শাসক শ্রেণি পাকিস্তান ও চীনের বিষয়টি জিইয়ে রাখবে। পাকিস্তানের সঙ্গে উত্তেজনা কমতে দেবে না। আবার চীনের সঙ্গেও উত্তেজনা রাখতে চাইবে। যুদ্ধ যুদ্ধভাব তৈরি করবে, তবে যুদ্ধে লিপ্ত হবে না। যুদ্ধ এবং হিন্দুত্বের রাজনীতি সেখানে শক্তিশালীই থাকবে। এ দুটি দিয়ে সেখানে পুঁজির সঞ্চায়ন ব্যাপক ঘটবে।

আলতাফ পারভেজ : পুঁজির সংকট সর্বত্রই। তবে ভারতে আঞ্চলিক সমস্যাটাও তীব্র হবে। আঞ্চলিক দলগুলো ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। তারা নিজেদের স্বার্থকে বড় করে দেখবে। এ সমস্যার সমন্বয় করতে না পারলে মাঝে মাঝে ঝামেলা হতে পারে। তবে সেটা চীন কিংবা পাকিস্তানকে দিয়ে তারা সামাল দেবে।

 গণমানুষের সংকট যে ভারতের রাজনীতিতে এখন গুরুত্ব পাচ্ছে না- এটিই বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে

আলতাফ পারভেজ : প্রয়োজনে তারা যুদ্ধ যুদ্ধভাবটা জিইয়ে রাখবে, যতদিন পুঁজির স্বার্থ থাকে। ভারতে প্রচুর ধনিক শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। বৈষম্য আরও বাড়বে। গণমানুষের সংকট যে ভারতের রাজনীতিতে এখন গুরুত্ব পাচ্ছে না- এটিই বড় ধরনের সংকট তৈরি করবে। এ সংকট আপাতত কাটিয়ে ওঠার লক্ষণ নেই।

আলতাফ পারভেজ : হ্যাঁ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মতো এত খারাপ অবস্থান নেই সেখানে। অন্য দেশগুলোতে গণমানুষের দলগুলো তো নাই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভারতে এখনও আছে।

 মুসলমানদের অধিকার নিয়ে কথা বললেই তাকে পাকিস্তানের চর বা সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে

ভারতের অভ্যন্তরীণ সংকট আরও তীব্র হবে বলে মনে করি। তীব্র হয়েছে অনেক জায়গাতে। যে বুদ্ধিজীবীরা মোদির নীতির বিরোধিতা করছেন, তাদের নকশাল বলে গ্রেফতার করা হচ্ছে। তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তারা হয়তো কোনো দলের সঙ্গে যুক্ত নন। তারা আদিবাসী, দলিত, মুসলিমদের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। মুসলমানদের অধিকার নিয়ে কথা বললেই তাকে পাকিস্তানের চর বা সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দেয়া হচ্ছে। পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে তো তা-ই দেখলাম। বিচারও হচ্ছে। তার মানে, ভারতে খারাপ অবস্থা শুরু হয়ে গেছে। ভীতির আবহ ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে।

বুক সেলফে মাও সেতুংয়ের একটি বই আছে, সেই অভিযোগে গ্রেফতার করার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। পাকিস্তান, বাংলাদেশে কিন্তু এখনও এ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।

আলতাফ পারভেজ : যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ভারতে, তার চেয়ে আর কী সংকট থাকতে পারে! সেখানে ক্রমাগত একটি রেজিমেন্টেড (নিয়ন্ত্রিত) শাসন ব্যবস্থা জারি হবে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আরও কমে যাবে। সবার ওপরই নজরদারি বাড়বে।

সামনের নির্বাচনে পরিবর্তন না ঘটলে ভারতে স্বৈরনীতি আরও কঠোর হবে। যদিও এখন সে চিত্র আমরা দেখতে পাই। ত্রিপুরায় বামপন্থীদের পরাজয়ের পর বহুকাল আগে লেনিনের বানানো ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হলো। বামপন্থী পত্রিকাগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো। এমন দৃষ্টান্ত ভারতে কম। কিন্তু বিজেপি সেটা করে দেখাল।

আসামে ৪০ লাখ মানুষ নাগরিকত্ব হারাল। কল্পনাই করা যায় না। কিন্তু বিজেপি করে ফেলল। বিজেপি যদি এবার সরকার গঠন করে তাহলে দেখবেন পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায় এনআরসি-তে (জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন) অনেকের নাম বাতিল করতে চাইবে। সেখানে গরিব মানুষকে রাষ্ট্রহীন করা হচ্ছে।

তবে বিজেপি যদি এবার অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক আসন পেয়ে বিরোধী দলে বসে, তাহলে সংকট কিছুটা কমতে পারে। আগে ভারতের রাজনীতি ছিল মধ্যপন্থীদের সঙ্গে বামপন্থীদের। এখন রাজনীতি হচ্ছে মধ্যপন্থীদের সঙ্গে ডানপন্থীদের। নির্বাচনে কে জিতবে সেটা যদি আমলে নাও নিই, তবে সেখানকার রাজনীতি যে নতুন প্যারাডাইসে (নন্দনকানন) প্রবেশ করেছে, তা হলফ করেই বলা যায়।

আলতাফ পারভেজ : ভারতের নির্বাচনে বাংলাদেশ সম্পর্কের হেরফের হবে না। কারণ সম্পর্কের মাত্রা নিরূপণ হয় দুটি পক্ষের চাওয়ার ওপর। বাংলাদেশ সরকার বর্তমান সম্পর্কের পরিবর্তন চাইছে না। ভারতও চাইবে না।

তবে ভারতে যদি আঞ্চলিক দলগুলোর সমন্বয়ে তৃতীয় কোনো শক্তি ক্ষমতায় আসে, তাহলে সম্পর্কের পরিবর্তন আসতে পারে।

বিজেপি ফের ক্ষমতায় আসলে সার্ক আরও নিষ্ক্রিয় হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের বিষয়গুলো সার্কের মাধ্যমেই আলোচনা হওয়ার সুযোগ থাকে। ভারতের নির্বাচনে যদি বর্তমান শাসকনীতিই জারি থাকে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য কোনো মঙ্গল বার্তা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *