নিজস্ব প্রতিবেদক:-শনিবার বিকেলে সিলেট শিল্পকলা একাডেমিতে সিলেটে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল।
সিলেটসহ আট বিভাগ সফর শেষে নির্বাচনের যথেষ্ট অনুকূল পরিবেশ দেখেছেন মন্তব্য করে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘পোস্টার ছেঁড়ার মতো অভিযোগ ছাড়া বড় কোনো অভিযোগ নেই কোথাও।
বিএনপির নির্বাচন বর্জন বড় চ্যালেঞ্জ নয় উল্লেখ করে এসময় তিনি বলেন, ‘তবে অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে নির্বাচন প্রতিহত করার কার্যক্রম গ্রহণ করলে, ভোটারদের যদি ভোটকেন্দ্রে যেতে বাঁধা দিলে সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
শনিবার বেলা সাড়ে ৩টায় সিলেট শিল্পকলা একাডেমিতে সিলেট অঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার বক্তব্যে এবং পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার আবু আহমদ ছিদ্দীকী এনডিসি’র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম।
বিএনপিসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে আসেনি। তারা নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছে। বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন কিনা প্রশ্নে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘যে কোনো নির্বাচনেই কিছুটা চ্যালেঞ্জ থাকে।
মূল একটা দল, তারা নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে, জনগণকে নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানাচ্ছে। এটা যদি ওভাবেই শান্তিপূর্ণভাবে বলে তবে বড় চ্যালেঞ্জ নয়। কারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নির্বাচনের পক্ষে যেমন বলা যায় তেমনি নির্বাচনের সমালোচনা করা সম্ভব। কিন্তু নির্বাচনকে প্রতিহত করা যাবে না।
এখন তারা যদি নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টা করে তাহলে চ্যালেঞ্জ যেটা আসবে, সেটা আমাদের মোকাবেলা করতে হবে।’
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি রয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন বর্জনের যে আহ্বান তা শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন করে প্রতিহতের দিকে যায় কিনা সেটি বুঝতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বলা হয়েছে। নির্বাচনের দিন বা তার আগে তাদের অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে নির্বাচন প্রতিহত করার কার্যক্রম গ্রহণ করে, ভোটারদের যদি ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান করা হয় তাহলে অবশ্যই এটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তবে সেই চ্যালেঞ্জ মোবাবেলা করার প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনের দিন বিগত সময়ের মতো ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ কমিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা বলে দিয়েছি, ব্যান্ডউইথ কমানো হবে না।
দুটি কারণে আমরা এটি চাচ্ছি কারণ অনেক অপপ্রচার করে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেককিছু বানিয়ে প্রচার করে নির্বাচন বরবাদ করতে চেষ্টা করেন-আমাদের সিদ্ধান্ত হচ্ছে ব্যান্ডউইথ থাকবে। যদি অপপ্রচার হয়-সেটা যে অপপ্রচার তা প্রচার করার জন্য, সত্যমিথ্যা নির্ণয় করতে এটি দরকার।’
সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিতে তৃণমূল বিএনপির করা দাবি নাকচ করে তিনি বলেন, ‘বিচারিক ক্ষমতা আজ পর্যন্ত কখনো সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়নি। ম্যাজিস্ট্রেসি হচ্ছে জুডিশিয়াল পাওয়ার, আর বিচারিক ক্ষমতা আর স্বশস্ত্র ক্ষমতা একসঙ্গে দেওয়ার কোনো নজির নেই। আমাদের দেশে অতীতে কখনও এটা দেওয়া হয়নি।’
সেনাবাহিনীর উপস্থিতিই ভোটাদের আশ্বস্ত করবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি স্বশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যখন রাস্তায় থাকবেন তখন তাদের যে উপস্থিতি, তাদের যে বিচরণ-সেটা নির্বাচনের জন্য একটা বড় ধরণের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করবে। মানুষ আস্থাশীল হবেন। এটাই যথেষ্ট।’
এর আগে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে দাবি করে বলেন, ‘সিলেটের ছয় আসনে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন তাদের সঙ্গে সকালে আমরা সভা করেছি। এখন (বিকেলে) আমরা প্রশাসনের যারা নির্বাচন পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। সকালের অংশে তাদের (প্রার্থীদের) সঙ্গে অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে আমরা মতবিনিময় করেছি। তাদের বক্তব্য শুনেছি। তাদের বক্তব্য যথেষ্ট ইতিবাচক ছিল। তারা কিন্তু পরিবেশকে যথেষ্ট অনুকূল বলেছেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে পোস্টার ছেঁড়ার কথা তারা বলেছেন, পোস্টার ছিঁড়া হয়েছে। সেটা আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের যারা ওই দায়িত্বে-ম্যাজিস্ট্রেট আছেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা আছেন, রিজিওনাল ইলেকশন অফিসার আছেন সবাইকে বলেছি, জিনিসগুলো দেখাভালের জন্য। সেটা খুব বড় অভিযোগ ছিল না।
গুজবে বিভ্রান্ত না হতে সবাইকে আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ কিছু কিছু কথা বলেছেন, আজগুবি কথা, যে ভোট যেখানেই হোক, ভোট তো এক জায়গায় চলে যাবে। এটার ব্যাপারে আমরা আশ্বস্ত করেছি বা আশ্বস্ত করারও প্রয়োজন পড়ে না-এটা এমনই একটা অবান্তর ধারণা যেটা কখনো সম্ভব নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো এক জায়গায় ভোট দিলে ভোটগুলো ঘুরে ফিরে আরো এক জায়গায় চলে যাবে-এটা কোনোভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। একশ শতাংশ নিশ্চয়তা দেওয়া যায় ওই ঘটনা ঘটবে না।
প্রার্থীদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উনাদের (প্রার্থীদের) বলেছি, আপনারা সাহস রাখবেন, এ ধরণের বিশ্বাস যে অমূলক সেটাও প্রচার করবেন। তা না হলে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে। এ ধরণের প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্তও করবেন না এবং আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং বিশ্বাসযোগ্য হবে।’
নির্বাচন যে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে সেটা ফুটিয়ে তোলারও চেষ্টা করবেন জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করব গণমাধ্যমের মাধ্যমে, পর্যবেক্ষকদের মাধ্যমে। কারণ গণমাধ্যমের যারা কর্মী তারা কিন্তু ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেন। আপনারা জানেন ভোট কেন্দ্রে যে কেউ ঢুকতে পারেন না। যারা ঢুকতে পারেন তাদের মধ্যে রয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কমকর্তা, সাংবাদিক, অবজারভার আর পোলিং অফিসার ও পোলিং এজেন্ট ও বৈধ ভোটার। অনুনোমদিত কেউ কেন্দ্রে ঢুকে ভোটকে প্রভাবিত করতে পারেন না। যদি করে থাকেন তাহলে গণমাধ্যমকেই সে ছবিগুলো তুলে নিতে হবে। তুলে সেগুলো সম্প্রচার করতে হবে এবং প্রকৃত অবস্থাটা যদি দেশবাসী বা বিশ্বাবাসীর কাছে গণমাধ্যমের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়, তাহলে যে একটা সঙ্কট, যেটাকে বলা হয় ক্রিডিবিলিটি সেটা কেটে যেতে পারে।
তিনি বলেন, ‘মানুষ যদি বিশ্বাস করে, শত শত ভোটার ভোট দিয়ে বেরিয়ে আসে যদি বলে, হ্যাঁ ভোটটা ভালো হয়েছে, আমরা ভোট দিতে পেরেছি এবং এটা যদি অসংখ্য কেন্দ্র থেকে অসংখ্যবার প্রচারিত হয় তাহলে জেনারেল পারসেপশনটা হবে, জনগণের কাছে ভোটটা বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। তাই মানুষ যাতে ভোট দিতে পারেন, সে ধরনের চেষ্টা আমাদের থাকবে, আপনাদেরও থাকতে হবে।’
মিথ্য তথ্য প্রচার করলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আজকাল ভীতিকর যেটা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডিজ ইনফরমেশন, ফেব্রিকেট করে যেটাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কোনো কিছু ফ্রেব্রিকেট করে যদি ছেড়ে দেওয়া হয় সেটায় আবার জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে। সে বিষয়ে আমরা সতর্ক থাকব। আমরা যদি জানতে পারি কেউ মিথ্যা তথ্য প্রচার করছে ফ্রেব্রিকেটেট করে, তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারবেন এ বিশ্বাসটুকু সৃষ্টি করতে চান জানিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘জনগণ যাতে আস্থাবোধ করেন এবং নির্ভয়ে, নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেন এবং ভোটাধিকার নির্বিঘ্নে প্রয়োগ করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বাড়িতে ফিরে আসতে পারবেন-এই বিশ্বাসটুকু সাধারণ জনগণের মধ্যে সৃষ্টি করতে হবে। এজন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিচরণের ঘনত্ব থাকবে এবং ফ্রিকোয়েন্সি অনেক থাকবে। তারা কিন্তু মোবাইল থাকবেন। যাতে ভোটাররা বিশ্বাস করেন রাষ্ট্র তাদের পাশে আছে, সরকার তাদের পাশে আছে।
সরকারের প্রতিটি সংস্থা, নির্বাহী প্রতিটি বিভাগ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা এই দায়িত্বটা তাদের বুঝিয়ে বলেছি। জনগনের কাছে কোনোভাবে তাদের আচরণের মাধ্যমে কোনো পক্ষপাতমূলক আচরণ যেন প্রতিফলিত না হয়। তবে ভালো কথা এখন পর্যন্ত আজ আমরা অষ্টম বিভাগ শেষ করছি, এ ধরনের কোনো অভিযোগ আমি পাইনি। পুলিশ খুব পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে, জেলা প্রশাসক, এসপি সাহেব এরা খুব পক্ষপাতমূলক আচরণ করছেন এরকম অভিযোগ খুব একটা শোনা যায়নি।’
তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রার্থীদের অভিযোগ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক প্রার্থীর সঙ্গে যখন আলোচনা করেছি দুই একজন হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ছোটখাটো অভিযোগ করেছেন পুলিশের বিরুদ্ধে। যেগুলো খুব নগন্য। আশা করি, তাদের আমরা বুঝাতে চেষ্টা করেছি নির্বাচনটা অবাদ, সুষ্ঠু এবং স্বচ্ছ হতেই হবে। যে কোনো মূল্যে হতেই হবে।’
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব যাদের উপর তাদের সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালনের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগামী দিনগুলোতে যদি তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে প্রতিপালন করেন তাহলে মানুষের আস্থাটা ফিরে আসবে, মানুষ আস্থাশীল হবে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে। ভোটাররা যদি আস্থার সঙ্গে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে আস্থার সঙ্গে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন তাহলে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হয়ে উঠে আসবে।’
সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার ব্যাপার রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের দেশিয় দায়িত্বই নয়, এটা কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল অবলিগেশন। কেন বাইরে থেকে বিভিন্ন দেশের লোক কথা বলে-এর কারণটা হচ্ছে আমাদের ইউনির্ভাসেল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস মূল ডকুমেন্ট ইউনাটেড নেশন্সের সদস্য হতে সেখানে কিন্তু গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য এটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড সেট করা আছে।
আরেকটি আছে আইসিসিপিআর বলে, ইন্টারনেশনাল কাবিল অ্যন্ড পলিটিক্যাল রাইটস সেখানে কিন্তু মানুষের ভোট দেওয়ার অধিকার এবং পাওয়ার অধিকার এবং কিভাবে নির্বাচিত হবে তার সুষ্পষ্ট করে বলা আছে। আমরা তাতে অনুস্বাক্ষর করেছি। কাজেই আমাদের রাষ্ট্রের প্রতি যেমন দায়বদ্ধতা আছে, ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিটির উপরে আমাদের দায়বদ্ধতা আছে।’
শুধু জনগণের কাছেই নয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও যে দায় আছে তা পূরণ করতে চান বলে জানান তিনি।