কুয়াকাটায় জীববৈচিত্র্য ভেঙে পড়েছে, কর্তৃপক্ষ উদাসীন

পোস্ট এর সময় : ১২:০৯ পূর্বাহ্ণ , ভিজিটর : ২৩

আল ইহসান: পায়রা ও পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর পর্যটন ব্যবসার বিশাল সম্ভাবনার পাশাপাশি কুয়াকাটা, পটুয়াখালীতে ব্যাপক পরিবেশ দূষণও শুরু হয়েছে যা ইকোসিস্টেম (বাস্তুতন্ত্র)—এ খারাপ প্রভাব ফেলছে।
কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (কুটুম) সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব দৈনিক পিআইবিকে বলেন, পায়রা ও পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে তিনগুণ/চারগুণ পর্যটক বৃদ্ধি পেয়েছে।
মেরিন রেস্তোরাঁ ও কাবাবের ব্যবস্থাপক মোঃ সাইদুল দৈনিক পিআইবিকে বলেন, সেতু দুটি চালু হওয়ার পর কত গুন পর্যটক বেড়েছে সেটার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের কাছে নেই। আগে শুধু ছুটির দিনগুলোতে টুরিস্ট ভীড় করতো, এখন তাদের অডার্র মেনটেন করতে আমরা পাগল হয়ে যাই।
প্রতিবেদক কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত পরিদর্শনে গেলে সেখানে প্রচুর অপচনশীল পণ্য ও পলিথিনের মতো বর্জ্য পাওয়া যায়। সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা—সংক্রান্ত কোনো কর্মচারী পাওয়া যায়নি। কুয়াকাটা পৌরসভায় আধুনিক বর্জ্য ডাম্পিং ব্যবস্থা নেই। বাসাবাড়ি ও আবাসিক হোটেলের বর্জ্য ও আবর্জনা প্রতিদিন ট্রাকে করে শরীফপুরের খোলা জায়গায় ফেলা হয়। যেখানে ময়লা—আবর্জনা ছড়িয়ে—ছিটিয়ে থাকায় বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই রাস্তার পাশ দিয়েই পর্যটন স্পট লেম্বুরবন, তিন নদীর মোহনা, শুটকি পল্লী এলাকায় যেতে হবে।
পদ্মা ও পায়রা সেতুর সুবিধার কারণে যাত্রীরা যেমন দ্রুত কুয়াকাটায় আসতে পারে, তেমনি তারা একদিনের মধ্যে সমুদ্র সৈকত থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা তৈরি করে। তাই প্রতিদিন প্রচুর বাস আসে যা হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার করে এবং যাত্রীরা প্রতিটি বাসে চিত্তবিনোদনের জন্য একটি উচ্চ—ভলিউম সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে। একটি মোটরযানকে ৮৫—ডেসিবেল পর্যন্ত সাউন্ড রেঞ্জ ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়, কিন্তু কখনও কখনও, এটি কুয়াকাটায় ১০৫—১১০ ডেসিবেল অতিক্রম করে, যা কানের পর্দাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সেভ দ্য ডলফিনের সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার দৈনিক পিআইবিকে জানান, ২০১৮ সালে সমুদ্র সৈকতে ১২টি মৃত ডলফিন, ২০১৯ সালে ১৮টি ডলফিন, ২০২০ সালে ২০টি ডলফিন, ২০২১ সালে ২৪টি ডলফিন, ২০২২ সালে ১৯টি ডলফিন মৃত অবস্থায় ভেসে উঠেছিল।
তিনি আরো বলেন, একটি মৃত তিমি ২০১৮ সালে সমুদ্রে সৈকতে পাওয়া গিয়েছিলো এবং আরেকটি ২০২২ সালে এসেছিল। দুটি মৃত কচ্ছপ ২০২১ সালে সমুদ্র সৈকতে এবং ২০২২ সালে নয়টি কচ্ছপ ভেসেছিল। প্রতি বছর আমরা সমুদ্র সৈকতে ২০/২৫ টুকরো মৃত রাজকাঁকড়া দেখতে পাই, কিন্তু গত বছর আমরা সমুদ্র সৈকতে ৫০ টিরও বেশি রাজকাকড়া মৃত পাওয়া গেছে।
এটি উল্লেখ্য যে রাজকাকড়ার নীল রক্তের জন্য একটি অত্যন্ত মূল্যবান প্রাণী। নীল রক্ত ওষুধ ও ভ্যাকসিন তৈরির কাজে লাগে। রক্ত সংগ্রহের পরিমাণের যোগ্যতা অনুযায়ী একেকটি রাজকাঁকড়ার মূল্য সাত লাখ টাকার বেশি।

কুয়াকাটায় বাইকের চাকায় প্রতিদিন প্রাণ হারায় হাজার হাজার কাঁকড়া

প্রতিবেদক কুয়াকাটার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে জানতে চাইলে কুয়াকাটা পৌরসভার মেয়র আনোয়ার হাওলাদার দৈনিক পিআইবিকে বলেন, আমি প্রতিদিন সমুদ্র সৈকত পরিষ্কার করার জন্য দশজন কর্মী নিয়োজিত করেছি। আমি সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হলেও এই কমিটির কোনো তৎপরতা নেই। সৈকত এলাকার উন্নয়নে কোনো আমি আজ অবধি কোন বাজেট বা অর্থায়ন পাই নাই।
হাইড্রোলিক হর্ন থেকে শব্দ দূষণ রক্ষা করার জন্য, তিনি দৈনিক পিআইবিকে নিশ্চিত করেছেন যে জুনের মধ্যে একটি স্থায়ী বাস স্ট্যান্ড স্থাপন করা হবে যা শব্দ দূষণ দূর করবে।
তিনি বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কুয়াকাটা পৌরসভায় আধুনিক ডাম্পিং স্টেশন স্থাপনের জন্য সরকার ২৫ কোটি টাকার বাজেট পাস করেছে। কিন্তু এখনও টেন্ডার হয়নি।
তিনি উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্পটি যথাসম্ভব রাস্তা দিয়ে শেষ করার পরামর্শ দেন কারণ সঠিক পরিবহনের অভাবে যাত্রীরা অটোরিকশা এবং মটর—সাইকেল নিয়ে খুব ভোরে সূর্যোদয়ের দৃশ্য উপভোগ করতে যায় যার চাকার চাপে পিষ্ট হয়ে বেশিরভাগই কার্ব এবং অন্যান্য ছোট প্রাণী মারা যায়।
পানির উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় তিনি কুয়াকাটাকে সমুদ্রপৃষ্ঠের পানি থেকে বাঁচানোর পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ২০/২৫ বছর আগে সমুদ্র সৈকত বর্তমান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক কিলোমিটার দূরে ছিল। এখন এটি বাঁধ থেকে মাত্র ২০০ মিটার দূরে।
ইউএসএআইডি—এর অধীনে ইকোফিশ—২—এর গবেষণা সহযোগী সাগরিকা স্মৃতি দৈনিক পিআইবিকে বলেছেন যে জেলিফিশ মারা যাওয়া পরিবেশের দুর্বলতার একটি লক্ষণ, কারণ যখন জেলিফিশ গভীর সমুদ্রে থাকার জন্য উপযুক্ত পায়না উঞ্চতা বৃদ্ধি বা জেলিফিশ খাওয়ার জন্য কিছু প্রজাতির অভাবে যাকে গবেষকরা ফিশ স্টক এ্যাসেসমেন্ট বলেন। তখন সমুদ্রের উপরের স্তরে জেলিফিশের প্রাদুর্ভাব মানে ইকো সিস্টেম বিশৃংখল বা ডিজঅর্ডার। সমুদ্র সৈকতে জেলিফিশ দেখা গেলে এক বছরের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানবে।
নারী এ গবেষক আরো জানান, পর্যটকরা পলিথিনের তৈরি বর্জ্য সৈকতে ফেললেও সমুদ্র সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটি ঠিকমতো বর্জ্য পরিষ্কার করে না। সমুদ্র সৈকতে আমাদের বর্জ্য সংরক্ষনের কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। পলিথিন সমুদ্রে জমা হয়ে সূর্যের আলোতে বাধা সৃষ্টি করে পরিবেশকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলছে। এটি লিথাল/ প্রাণঘাতী অঞ্চল সৃষ্টি কেও যা সমুদ্রের স্বাভাবিক আপওয়েলিং এবং ডাউন ওয়েলিং প্রভাহিত হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে, যা ইকোসিস্টেমের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইউট্রোফিকেশন প্রকৃতিকে প্রভাবিত করে। বর্তমানে মাছ, শামুক, চিংড়ি এবং কার্ব—এ মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ পাওয়া যায়। এটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও বিপজ্জনক।
আন্তর্জাতিক সংস্থার এ প্রতিনিধি জানান, পৌরসভার লোকজন খাপড়াপাড়া ও আন্ধারমানিক নদীতে নিয়মিত বর্জ্য ফেলার ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো তৎপরতা নেই। আমরা প্রায়ই এমন জীবিত কচ্ছপ পাই, যাদের সাথে শরীরে ছেড়া জাল পাই। রাজ কাকঁড়া ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্রে তীরে আসে, যারা জালে বেঁধে মারা যায়। পৌরসভা রাতে বর্জ্য অপসারণের নামে করে পলিথিনগুলো আগুনে পোড়ায়। এটি পরিবেশের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর।


আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতি গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, আমরা ৬ বছর ধরে মাছধরা মাঝিদেরকে হাঙ্গর, রে মাছ, কচ্ছপ, ডলফিন শিকারে অনুৎসাহিত করি, কিন্তু কেউ পাত্তা দেয়নি। গত বছর শুরুতে যখন আমরা এসি ল্যান্ড, ফরেস্ট বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আইন প্রয়োগে নিয়োজিত করি তখন এগুলো ধরা নিয়ন্ত্রিত হয়। ভ্রাম্যমাণ আদালত বন আইন ২০১২, প্রয়োগ না করলে মানুষ আইন মানে না তা প্রমাণ পেয়েছি।
ভবিষ্যৎ ব্লু ইকোনমি উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমুদ্র সমৃদ্ধি অর্জন করতে হলে সামুদ্রিক প্রাণীকে নিতে হবে। আমরা হাঙ্গরকে বলি ডাক্তার আর রে মাছকে বলি সাগরের ইঞ্জিনিয়ার। সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন যদি বিপন্ন হয় তাহলে নীল অর্থনীতি সুদূর পরাহত।
নারী এ বিজ্ঞানী অভিযোগ করেন, সমুদ্র সৈকত রক্ষায় যে জিও ব্যাগ ব্যবহার করা হয় তা পরিবেশের জন্য উপযুক্ত নয়। তিনি সমুদ্র সৈকতে ব্যবহারের জন্য একটি পরিবেশ বান্ধব ব্যাগ দাবি করেন।


সমুদ্র সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে কলাপাড়া উপজেলার ইউএনও (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সম্প্রতি এখানে যোগদান করায় তিনি সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর খবর এই প্রথম জানলেন।
পটুয়াখালীর ডিসি (জেলা প্রশাসক) মোঃ শরিফুল ইসলাম দৈনিক পিআইবিকে বলেন, “আমরা শীঘ্রই সমুদ্র সৈকত পরিষ্কার করার জন্য কিছু নতুন লোক নিয়োগ করব। পৌরসভা একটি বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থাপনা স্থাপনের জন্য প্রকল্প নিয়েছে। সমুদ্র সৈকত বেড়িবাঁধ রক্ষা বাঁধ বিশ্বব্যাংকের একটি প্রকল্প হওয়ায় প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে জানি না এই প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট পানি উন্নয়ন বোর্ডও আমাকে জানাতে পারেনি।
জিওই ব্যাগ একটি প্রযুক্তিগত বিষয় হওয়ায় জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পানি বিভাগের পরামর্শ করে ভবিষ্যতে সমুদ্র সৈকত রক্ষার জন্য ব্যাগ বানানো উচিত বলে তিনি মত প্রকাশ করেন ।
উল্লেখ্য যে, জার্মান ওয়াচের ২০২১ গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স (সিআরআই) অনুসারে জলবায়ু ধ্বংসের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। এটি অনুমান করা হয়েছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনের একজন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হবে। বিশেষত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৯.৬ ইঞ্চি (৫০ সেমি) বৃদ্ধির সাথে সাথে, বাংলাদেশ ততদিনে তার প্রায় ১১% ভূমি হারাতে পারে এবং শুধুমাত্র সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ১৮ মিলিয়ন লোককে স্থানান্তর করতে হতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *