ইদে বাড়ি ফেরার সংস্কৃতি

পোস্ট এর সময় : ৩:০৬ অপরাহ্ণ , ভিজিটর : ২৪

ড.খ.ম. রেজাউল করিম:-আর একদিন পর বাঙালি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ইদুল ফিতর। ইদ মানে আনন্দ, ইদ মানেই উচ্ছ্বাস, ইদ মানেই বাড়ি ফেরা। এক মাস সিয়াম সাধনার পর ইদুল ফিতর আসে খুশি আর আনন্দের বার্তা নিয়ে। ইদকে কেন্দ্র করে সমাজের প্রায় সকল বয়স, শ্রেণি-পেশার মানুষের থাকে নানা আয়োজন। এরমধ্যে অন্যতম আয়োজন হলো ইদে বাড়ি ফেরা। ইদ উপলক্ষে নাড়ির টানে পরিবারের সকলের সাথে সম্মিলনের জন্য বাংলাদেশের মানুষ তাদের কর্মক্ষেত্র বা অস্থায়ী আবাস ছেড়ে পাড়ি জমায় জন্মভিটায়। কেউ বাসে, কেউ ট্রেনে কিংবা লঞ্চে, কেউ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়। আর কিছু সংখ্যক মানুষ বাড়িতে যান আকাশপথে। যাত্রাপথের ভোগান্তির সঙ্গে যানবাহনের টিকিট পাওয়াও কঠিন কাজ। ফলে যারা বাড়ি ফেরেন, তাঁদের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়্,ে যার প্রভাব নানাভাবে অনুভূত হয়। সঙ্গে সন্তান-সন্ততি থাকলে তো কথাই নেই। ফলে অনেকের কাছেই ইদে বাড়ি ফেরার বিষয়টি রীতিমত আতঙ্কে পরিণত হয়। তা সত্ত্বেও মানুষের এই বাড়ি ফেরা থেমে থাকে না। গণমাধ্যমের ভাষায়, নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে নগরায়ন তথা নগরের বিকাশ ঘটেছে দ্রুতগতিতে। বর্তমানে দেশের মোট জনসংখ্যার ৩১.৬৬ শতাংশ মানুষ নগরে বাস করে। জনবিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৪৫ শতাংশ নগরে বসবাস করবে। নগরগুলো আজ শিল্পায়নসহ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানাাবধ কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠায় দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মূলত কর্মসংস্থানের আশায় মানুষ নগরে পাড়ি জমায়। সঙ্গত কারণে প্রতি বছর ইদকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশের প্রান্তিক এলাকায় আবার ছড়িয়ে পড়ে। ইদের ছুটিতে বাড়িতে ফেরা এদেশের মানুষের কাছে অনেকটা নিয়ম বা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টাকে বাড়ি ফেরার সংস্কৃতি বলা যেতে পারে।
বিশ্বে মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৩ ভাগ মুসলিম। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো ও ব্যাপক উৎসাহ ও ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে ঈদ-উল-ফিতর পালন করে থাকে। এর মধ্যে একটি বিশেষ ঐতিহ্য হলো ঈদে বাড়ি ফেরা। জানা যায় ইন্দোনেশিয়ার বেশির ভাগ মুসলিমই পরিবার ও বন্ধু বান্ধব নিয়ে ঈদ পালন করতে শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমায়। জানা যায় এবারের ইদুল ফিতর উপলক্ষে ইন্দোনেশিয়ার প্রায় ৯ কোটি মানুষ তাদের কর্মস্থল থেকে গ্রামের বাড়িতে যাবে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ২৬.৮৮ শতাংশ ঢাকা বিভাগে বসবাস করে। ঈদে কত লোক ঢাকা ছাড়েন তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে কমপক্ষে অর্ধেক নগরবাসী যে ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে যান সে বিষয়ে কারো সন্দেহ নেই। সেই হিসেবে ১ কোটি ৭০ লাখ জনসংখ্যার এই শহর থেকে ইদুল ফিতর উপলক্ষে ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ ইদের আগে বাড়ি ফিরতে আগ্রহী। এই হিসাব অনুযায়ী প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ পরবর্তী ৪ দিন এ শহর ছাড়বে জন্মভিটার উদ্দেশ্যে। উল্লেখ্য প্রতিদিন ঢাকা থেকে দেশের সকল জেলায় চলাচলকারী যানবাহনের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ১৬ লাখ। এরমধ্যে ৮ লাখ বাসে, ১ লাখ ট্রেনে, ১.২৫ লাখ লঞ্চে, ৩ লাখ বাইকে এবং ৩ লাখ ব্যক্তিগত গাড়িতে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির সভাপতির মতে, ১৬ এপ্রিল থেকে ঈদযাত্রা শুরু হলেও প্রধানত ১৮ এপ্রিল বেতন-বোনাস পাওয়ার পর ১৯ এপ্রিল থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ হারে মানুষ রাজধানী ছাড়বে। তিনি আরও বলেন, গণপরিবহণে সড়কপথে ৬ থেকে ১০ লাখ, নৌপথে ৮ থেকে ১০ লাখ, রেলপথে দেড় লাখ যাত্রী ওভারলোড হয়ে যাতায়াত করতে পারে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর দেয়া এক তথ্যমতে, গত ১৮ এপ্রিল ঢাকা ছেড়েছেন ১২২৮২৭৮ জন সিম ব্যবহাকারী।

জীবন-জীবিকার তাগিদে বড় বড় শহরে আবাস গড়ে তোলেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বসবাসকারী মানুষ। ফলে এসব নগরের অধিকাংশ মানুষের নিজস্ব আবাস নেই। তাদের বেশিরভাগ ভাড়া বাসায় থাকেন। তাই ইদের তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ ছুটিতে তাদের অধিকাংশই চান পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে ইদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। সবারই মনের গভীরে বাড়ি বলে যে চিত্রটি অংকিত থাকে তার অবস্থান কিন্তু গ্রামে। ইদ উপলক্ষে সেই বাড়ি বা গ্রামে কয়েক দিনের জন্য হলেও ফিরে যাওয়া, এ যেন নিজেকেই ফিরে পাওয়া। নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই উৎসব আয়োজনে নগরবাসীর গ্রামমুখী হওয়ার নানা কারণ রয়েছে। এখনো ঢাকার ৬০ ভাগ পরিবার প্রধানের জন্ম গ্রামে। আবার ঢাকায় যাঁরা মাইগ্র্যান্ট, তাঁদের অধিকাংশের শহরে বাড়ি নেই। তাঁদের পরিবারের একটি অংশ নিজ গ্রামে বা অন্য এলাকায় কাজের জন্য থাকেন। কেউ আছেন, যিনি শুধু নিজেই ঢাকায় থাকেন, পরিবার গ্রামে থাকেন৷ এসব কারণে উৎসব আয়োজনে তাঁরা গ্রামে যান

ইদ-পার্বণে বাড়ি ছুটে যাওয়া, এটা এ দেশের মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য। আত্মীয়-স্বজনদের সাথে ইদ করার জন্য সবাই বাড়ি ফেরে। চোখে মুখে খেলা করে অন্যরকম দ্যুতি! কী সেই অমোঘ টান যার জন্য মানুষ হাজারো কষ্ট স্বীকার করে ঘরে ফেরে? যানবাহনে কোথাও পা ফেলার উপায় থাকে না, তবুও কারো মাঝে নেই এতটুকু বিরক্তি। সবাই নিজে এবং চেনা-অচেনা মানুষদের সাথে ফেরে আপন নিবাসে।
ঈদ কেবল বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবই নয়, আনন্দ-বিনোদন এবং মিলনমেলাও। প্রিয়জনের সাথে ইদ করা, কারও বাবা-মার প্রতি টান, কারও পূর্বপুরুষের ফেলে যাওয়া বসতভিটার প্রতি অনুরাগ, কেউ সন্তানকে তার শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ করিয়ে দিতে চান। কেউ কেউ চান পরিবার ও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া প্রতিবেশি সবার সঙ্গে দেখা ও কুশল বিনিময় করতে। পারিবারিক বন্ধন বা সংহতি বজায় রাখার তাগিদও অনেকের মধ্যে লক্ষ করা যায়। এমন অসংখ্য কারণ নগরবাসীদেরকে তাদের নিজ গ্রামের বাড়িতে টেনে নিয়ে যায়। এই ফিরে যাওয়ায় অনেক সময় প্রেরণা হয়ে থাকে, গ্রামের দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠ, খেলার মাঠ, স্কুল বা কলেজ প্রাঙ্গন, পুকুরপাড়, বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে আড্ডা, সবাই মিলে খেলাধুলা, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীটি। যে খালে নাইতো ছোট বেলায়, যে বটগাছটির কাছে গিয়ে আশ্রয় মিলত রোদে-বৃষ্টিতে, সবই মনের মধ্যে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর গ্রামীণ সমাজও মানুষের ইদে নগর ছাড়ার অন্যতম কারণ। এখনো দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে গ্রামীণ কৃষির উপর নির্ভরশীল। ফলে এ দেশের নগরে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগের শিকড় মূলত গ্রামে। এখনো কারও বাবা-মা, চাচা-চাচি, কারও দাদা-দাদি, নানা-নানি বা অন্যান্য আত্মীয় স্বজনরা রয়ে গেছে গ্রামে। এক বা দুই প্রজন্মের নগরবাসী হয়েও তারা কিন্তু সেই শিকড় ভুলতে পারে না। সঙ্গত কারণেই তারা ইদের আনন্দে ফিরে যেতে চায় সেই শিকড়ের কাছে। যদিও নাগরিক ব্যস্ততা ক্ষনিকের জন্য এসব আবেগ-অনুভূতিকে চাপা দিয়ে রাখে। তবে ছুটির দিনগুলোতে সেই পুরানো স্মৃতিগুলো কাতরাতে থাকে। ফলে অনেক দূরে অবস্থান করলেও, মন চলে যায় স্মৃতির আঙিনায়।

ইদ পর্বের সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক কিছু বিষয় জড়িত থাকে। যেমন- অনেকেই ইদের দিন সকালে ইদগাহ মাঠে নামাজ আদায় করার পরপরই চলে যান মৃত মা-বাবা বা দাদাদাদি, নানানানির কবর জিয়ারত করতে। জানা যায় প্রাচীনকালে যাযাবর মানুষের স্থায়ী আবাস গঠনে সহায়তা করেছে এই কবর। তাই নগরে অনেকের স্থায়ী আবাস হলেও, অন্তত বাবা-মাসহ অন্যান্য নিকট আত্মীয় স্বজনদের কবরের টানেও তাকে ফিরে যেতে হয়। সারা বছর না গেলেও অন্তত ইদের ছুটিতে যাওয়ার সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না। ইদে বাড়ি ফেরার এটিও একটি কারণ বলে মনে হয়।

গ্রামে ফেরার সুফল হচ্ছে গ্রাম-নগরের মেলবন্ধন। স্বল্প সময়ের মেলামেশায় যেটুকু ভাবের আদান-প্রদান ঘটে তা আত্মিক উন্নয়নে সুদূর প্রসারী প্রভাব রাখে। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থার বিকাশ এমনিতেই নগর ও গ্রামের মধ্যকার দূরত্ব কিছুটা হলেও কমিয়ে দিয়েছে। ইদ উপলক্ষে গ্রামে ফেরা এ ধারাকে আরো এগিয়ে নিতে পারে। যান্ত্রিকতার এই যুগে ভাইবোনের ছেলেমেয়েরা অনেকেই একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে না। ইদের সময় বাড়িতে গিয়ে এরা সবাই মিলিত হয়। একে অন্যের সঙ্গে কুশল, মুঠোফোনের সংখ্যা বিনিময় করে। ফেসবুক, টুইটারে একে অন্যের বন্ধু হয়। এভাবে পরবর্তী প্রজন্মের উভয়ের মধ্যে মেলবন্ধন স্থাপিত হয়। এমন ঘটনা এখন সব পরিবারের মধ্যেই দেখা যায়। সেই দিকে বিবেচনায় ইদ সবার কাছে একটা সম্মিলনের উৎসব। এছাড়া ইদ উৎসবের মধ্যে নানা পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডও সম্পন্ন হয়। যেমন- অনেক সময় আত্মীয়স্বজনের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি বা মনোমালিন্য হতে পারে। ইদ একটা সুযোগ করে দেয় এসব পারিবারিক বিবাদ বা ঝামেলা নিরসনের। আবার জমিজমা সংক্রান্ত নানান জটিলতা বা পারিবারিক অন্যান্য সমস্যার বিষয়ে এ সময় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ইদানিং বিবাহ, জন্মদিন, বিবাহবার্র্ষিকী, খৎনা, আকিকা এই অনুষ্টানগুলো ইদের মৌসুমে গ্রামের বাড়িতে অনুষ্টিত হতে দেখা যায়। কারণ বছরের এই সময়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পরিবারের সকল সদস্য বাড়িতে ফিরে আসে। ফলে এ ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরি হয়। ঈদ উৎসব যেন সব উৎসবকে ছাপিয়ে যায়। মিলনমেলায় রূপান্তরিত এ উৎসবে দৃঢ় হয় পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন।

ইদানিং স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরকে ইদের সময় বাড়িতে এসে পুনর্মিলনীর আয়োজন করতে দেখা যায়। অনেক সময় একই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাচভিত্তিক পুনর্মিলনী চোখে পড়ে। সাধারণত ইদের পরের দিন থেকে এ রকম আয়োজন অধিক অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। এছাড়া ইদুল ফিতরের আগে রোজার মধ্যে প্রিয় স্কুল বা কলেজ মাঠে এসব ব্যাচের ইফতার পার্টির আয়োজন চোখে পড়ে। এ ধরনের পুনর্মিলনী ইদের আনন্দকে আরো বাড়িয়ে দেয়। ফলে নতুন প্রজন্মের সদস্যরা গ্রামের বাড়িতে আসার এক ধরনের তাগিদ অনুভব করে।
এবারের ইদ আনন্দের হোক, সুখের হোক। এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সমাজের সকল বয়স, পেশা-শ্রেণির মানুষের মধ্যে। সবাইকে ইদ মোবারক।
ড.খ.ম. রেজাউল করিম
সমাজ গবেষক ও শিক্ষক
সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *